গভীর অরণ্যের ছায়াবিথীতলে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই গড়ে উঠেছিল সখিপুরের নন্দিত ললিত সভ্যতা। সমৃদ্ধ হয়েছিল শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। সৃজনশীল উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সখিপুরের মানুষের চিন্তা ছিল একধাপ এগিয়ে, যার ফলস্বরূপ সখিপুরবাসী পেয়েছিল একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। আর সেই সমৃদ্ধ সভ্যতার বিকাশের পথ প্রদর্শক হিসেবে স্বাধীনতার ঠিক ৫৮ দিন পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি মুজিব কলেজ নামে বর্তমানে সরকারি মুজিব কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কাদেরীয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম-এর নেতৃত্বে তার বেসামরিক সহকারী প্রধান হামিদুল হক বীরপ্রতীকসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে হিরন্ময় স্বর্ণাভ্য এক মুহুর্তে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় তাঁর নামানুসারে কলেজটির নামকরণ করা হয় ‘মুজিব কলেজ’। এই অনগ্রসর অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার পথকে সুগম করার লক্ষ্যেই মূলত কলেজটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসহ অধ্যক্ষ, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এবং শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ দ্রæত সম্পন্ন হয়। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। কলেজের উন্নয়নের সাথে এলাকার সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, হামিদুল হক বীরপ্রতীক, প্রয়াত এমপি কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান একযোগে কাজ করে যান। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। পরে তিনি স্বেচ্ছায় ভারতে নির্বাসন গ্রহণ করেন। তৎকালীন সামরিক জান্তারা কলেজটিতে মিলিটারী ক্যাম্প স্থাপন করে এবং কলেজের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সখিপুর সফরে আসলে সখিপুর কলেজের নামে দুই লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য ‘মুজিব কলেজ’র স্থলে ‘সখিপুর কলেজ’ নাম ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে আব্দুস সালাম ফকির সাহেব টাঙ্গাইল জেলা জজ কোর্টে একটি মামলা করেন। ঐ মামলার রায়ের বলে কলেজটির পূর্বের নামকরণ অর্থাৎ ‘মুজিব কলেজ’ নামটি পুণর্বহাল হয়। ১৯৮৪ সালে সখিপুর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও শাহজাহান সিদ্দিকী বীরবিক্রমের সহায়তায় কলেজটির কার্যক্রম পুণরায় শুরু করেন কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান, হামিদুল হক বীর প্রতীক, শেখ মোহাম্মদ হাবীব প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সহায়তায় ২৪/০২/১৯৮৭ খ্রি.. হতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা কর্তৃক উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠদানের অনুমতি পায়। ১৫/০৩/১৯৮৭ খ্রি. কলেজটি প্রথম এমপিও ভূক্ত হয়।। এরপর ১৩/০২/১৯৯৫ খ্রি. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ¯œাতক (পাস) শ্রেণির অধিভূক্তি লাভ করে এবং ১৭/০৪/২০০৪ খ্রি. কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে এইচএসসি (বিএম) শাখার অধিভূক্তি পায়। কলেজটির তৎকালীন গভর্নিংবডির সভাপতি কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহানের একান্ত প্রচেষ্টায় জাতীয় সংসদের হুইপ জনাব নূর-ই-আলম চৌধূরীর সমন্বয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিতে ০৫/০৭/২০১২খ্রি. জাতীয় বিশ্ব^বিদ্যলয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিষয় দুটিতে অনার্স কোর্সের অধিভূক্তি লাভ করে। এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি এবং কলেজটির তৎকালীন গভর্নিংবডির সভাপতি কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহানের একান্ত প্রচেষ্টায় কলেজটি ১০/০৮/২০১৫ খ্রি: তারিখে মানবতার জননী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতীয়করণ করা হয়। ২০১৮ খ্রি. কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীগণ ‘২০০০ সালের বিধিমালা’ অনুযায়ী আত্তীকরণ হয়। ০১/০৭/২০১৯ খ্রি. তারিখে কলেজটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৪তম বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের শিক্ষা ক্যাডার প্রফেসর ড. ছদরুদ্দীন আহমদ। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ ধরে যেভাবে এগিয়ে চলেছে সরকারি মুজিব কলেজ নি:সন্দেহে তা প্রশংসনীয়। এই অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে বর্তমানে কলেজের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তথ্য ডিজিটাল করে একটি সফটওয়্যারে আনা হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাস সম্পূর্ণরূপে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। অফিসসহ অনার্সের প্রতিটি বিভাগে ইন্টারকম টেলিফোন চালু করা হয়েছে। মাসিক পরিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি পরিক্ষার ডিজিটাল মার্কশীট প্রদান করা হচ্ছে এবং মোবাইল মেসেজ’র মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। কলেজের উন্নয়নে এবং লেখাপড়ার মানোন্নয়নে এলাকার মানুষের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। উন্নয়নশীল এলাকার ঝরে পরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কথা চিন্তা করে ১১/১২/২০১৯খ্রি. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ এবং বিএসএস শ্রেণির অধিভূক্তি লাভ করেছে। ১৪/০১/২০২০খ্রি. কলেজটিতে ব্যবস্থাপনা, বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, ভূগোল, ইসলাম শিক্ষা, হিসাববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, গণিতসহ ১২টি বিষয়ে অনার্স কোর্স খোলার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সুপারিশ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য যে, এই ১২টি বিষয় অধিভূক্ত হলে আগের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিষয় দুইটিসহ ১৪টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু থাকবে সরকারি মুজিব কলেজে। খুব শীঘ্রই কলেজের একটি প্রবেশ গেট, শহীদ মিনার, একাডেমিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হোস্টেল, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও খেলাধুলার উন্নয়ন এবং কলেজের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফুল বাগানের চলমান উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বর্তমান সময় আগামী দিনের ইতিহাসে কলেজের শ্রেষ্ঠতম সময় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। -সম্পাদনা মো. আলীম মাহমুদ, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।